একটি আসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প

ভালোবাসা / ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)

মাহমুদ সজীব
আমার পরিচয় দিয়েই শুরু করি , আমি তানবির হায়দার আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ,একটা মফস্বল শহর থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন মানুষ। এটি আমার যুবক বয়সের গল্প হয়তোবা আমার সারা জীবনের গল্প একমাত্র গল্প।
কলেজে পড়ার সময়ের কথা ,মোটামুটি ভালো ছাত্রই ছিলাম ।পড়ালেখার পাশাপাশি কবিতা আবৃতি করতাম ,ডিবেট করতাম,কলেজের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কাজের সাথেও যুক্ত ছিলাম। শিক্ষক কিংবা ছাত্রছাত্রী দের কাছে ভালোই পরিচিতি ছিল, বলা যায় ভালোই জনপ্রিয়তা ছিল । বাবা-মায়ের খুব আদরের সন্তান ছিলাম ,আসলে আমি এত বেশি অনুগত ছিলাম আমার মা বলতো যে কোন বাবা মা আমাকে আদর করবে । ভালোই চলছিল আমার জীবন ,নিজেকে মনে হত সব চেয়ে সুখী মানুষ যার কোন কিছুর অভাব নাই ,ভুল টা ভাঙ্গে ওকে দেখার পর ।
ওকে আমি প্রথমে দেখি কলেজের একটা অনুষ্ঠানে । অসুস্থ থাকার কারনে কিছু দিন কলেজে যাওয়া হয়নি আমার তাই অনুষ্ঠানেও যাওয়ার কথা ছিল না , বন্ধুরা একপ্রকার ধরে নিয়ে গেল ; ভাগ্যিস ওরা আমাকে নিয়ে গেছে না হয় গল্পটা হয়তো অন্য রকম হত । কলেজে পা দিয়েই মিষ্টি কণ্ঠের কবিতা আবৃতি শুনলাম ,রবি ঠাকুরের কবিতা ; কণ্ঠের দরদ ভরা স্বর টাই আমাকে আকৃষ্ট করলো । মনের অজান্তেই যেন কোন যাদু-মন্ত্রের টানেই হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের সামনে চলে গেলাম, গিয়ে দেখি শ্যাম বর্নের একটা মেয়ে। না শ্যাম বর্ন না ওকে কালোই বলা যায়, মঞ্চ থেকে নেমে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ।
ওইদিন এই পর্যন্তই ছিল , পরের দিন কলেজে গেলাম দেখি মেয়েটি আমাদের আবৃতির ক্লাবে। এক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিল আমার সাথে ;মেয়েটিও খুব আগ্রহ নিয়ে বললো ও আমার কথা বন্ধুদের কাছে অনেক শুনেছে । আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না শুনে গেলাম ওর কথা। এই সময় পিছন থেকে একজন ওকে ডাকলো তিতির নামে । আমি শুনে জিজ্ঞেস করি তিতির কে ,জানতে পারলাম এইটা ওরই নাম ।আমাকে নাকি আগেই বলেছে কিন্তু আমি খেয়াল করি নায় , ওর কথা শুনে লজ্জিত হয়ে ক্লাব থেকে বের হয়ে গেলাম ।
আসার পথে চিন্তা করতেছিলাম ; না , ওকে নিয়ে না , ওর নামটা নিয়ে ।তিতির কেমন একটা অন্যরকম নাম। নামে কেমন একটা রহস্য আছে ,ভীত ভাব আছে,একটু উষ্ণ আদর আছে ,হ্যাঁ একটু কবিতার ছোঁয়া ও আছে ।
পরের দিন আবার দেখা ওর সাথে এইবার অনেকক্ষণ কথা হল , বুঝলাম ওর নাম তিতির কেন আর নামটা কতটা সার্থক। তিতির একটি বিরল প্রজাতির পাখি , বিলুপ্ত প্রায় বলা যায় ,হ্যাঁ ওকে ও ওই শ্রেণিতে রাখা যায় , ওর মানসিকতা বিরল প্রজাতির ছিল , আধুনিক বলা চলে কিন্ত বাঁধ ভাঙ্গা না ; ওর ভিতর ভীত একটা ভাব ছিল, মনে হত পৃথিবীর সকল কিছুতেই ওর ভয়, উপরের শক্ত খোলসের ভিতরে একটা অসহায় নারী মুর্তি ।
সত্যি কথা বলতে আমি প্রথমে ওর মানসিকতার ভক্ত হয়ে যায় । হুম; ‘একে প্রেম বলা চলে হয়তোবা মোহ ও যায় বলা যায়’ ।এই একটা জিনিস আমাকে ওর দিকে টেনে নিত । তাই বলে আমি বলতেছি না যে ও অসুন্দরি ছিল । হ্যাঁ, হয়তো কালো ছিল কিন্তু ওর নির্মল একটা মুখ ছিল, যাতে সবসময় পবিত্র একটা হাসি থাকতো । একহারা গঠনের দেহ ছিল , আর এমন দুইটা চোখ ছিল আমার মনে হয়না কেউ একবার তাকালে ওই দিকে দ্বিতীয় বার না তাকিয়ে থাকতে পারবে । অন্তত আমার কথা বলতে পারি আমি একবার দুইবার না বারবার ওই চোখের দিকে তাকায়ে ছিলাম ।
খুব অল্প সময়েই আমরা খুব কাছে চলে আসি । হ্যাঁ আমরা প্রেমে পড়েছিলাম , আমরা নিজেদের সঙ্গ উপভোগ করতাম। দূরে থাকলেও মনের আকাশে খুব কাছাকাছি থাকতাম । যখন একসাথে থাকতাম তখন কথা বলতাম ,একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতাম । আর যখন দূরে থাকতাম তখন একসাথে থাকা সময়ের স্মৃতিচারন করতাম ।আমি আসলে তার পাশে থাকতে চাইতাম। সকল কিছু থেকে তাকে আগলে রাখতে চাইতাম । হয়তো তার ভিতর নতুন কোন পৃথিবীর সন্ধান করতাম যা একান্ত আমার হবে,যার ভাগ কখনো কাউকে দিতে হবে না ।
ভালোই সময় কাটছিল কিন্তু সব কিছুর পরেও আমরা মানুষ , আমাদের কিছু সমস্যা থাকে । আমাদের কে অনেকের মতামতের উপর নির্ভর করতে হয় ।আমি ও ব্যতিক্রম ছিলাম না ; আমি আমার বাবা-মা কে জানায় তিতিরের কথা । তারা আমাকে জানায় তারা ওকে দেখতে চায় তারপর আমাকে তাদের মতামত জানাবে ।
কিছু দিন পর আমার ডাক আসে বাবা –মায়ের কাছ থেকে তারা আমাকে বলে এখানে সম্পর্ক করা সম্ভব না । মেয়ে কালো তাদের পছন্দ হয়নি। আমি অবাক হয়ে উত্তর দেই কারো কালো হাওয়াটা তার অপরাধ না আর আমি কালো জেনেই তিতির কে পছন্দ করেছি । তখন তারা আমাকে আসল সমস্যার কথা বলে ; যা আমি তিতিরের কাছে কখনো শুনি নায় ।আমি জানতাম না যে তিতির তার বাবা-মায়ের আপন মেয়ে না । তারা তাকে দত্তক নেয় কোন এক আশ্রম থেকে ,তার কোন পিতৃ পরিচয় নায় ,এমন একটা মেয়ে কে আমি বিয়ে করবো কিনা ?
না , এইবার আমার ভিতরের আসল মানুষ জেগে উঠে । আমি কেন পিতৃ পরিচয়হিন কাউকে বিয়ে করবো তাও সে দেখতে কালো ।এখন আমার আর এ কথা মনে হল না যে ‘কেউ পিতৃ পরিচয়হিন এতে তার কি দোষ’ । এখন পিতৃ পরিচয়হিন হওয়ার সাথে সাথে কালো হওয়া টাও তার দোষ । আমি তিতিরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই , এমন কি সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে এলাকা ছেড়ে তখন আমি ঢাকায় চলে আসি ।
ঢাকায় এসে এক নতুন জীবন শুরু হয় । সব ছেড়ে পরালেখায় মন দেই ।ধীরে ধীরে সময় কেটে যায় ,তিতিরের কথাও সব সময় মনে আসে না ।কখনো কখনো গভীর ধুমে হয়তো দেখি কালো মায়া ভরা দুটি চোখের বিষাদ হাসি বা মুখের কোনে তাচ্ছিল্লের ভাব।
আমি কেন আমার তিতিরের সাথে এমন করলাম । যার কথা না শুনলে, যাকে না দেখলে আমার ভিতরের সত্ত্বা টা আমার কাছে মৃত মনে হত তার সাথে কিভাবে এমন করলাম । আমি তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কেন পালিয়ে আসলাম ?
কারন আমি বাবা-মায়ের খুবই অনুগত ,কারন আমি তাকে অপরাধী মনে করি , কারন আমি দুর্বল। হ্যাঁ, কারন আমি দুর্বল আমার পক্ষে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না; একটি পরিচয়হিন মানুষকে নতুন পরিচয় দেয়ার সাহস আমার ছিল না ; একটা মানুষ কে শুধুমাত্র মানুষ পরিচয়ে গ্রহন করার সাহস আমার ছিল না । তিতির অপরাধী ছিল না, আমি দুর্বল ছিলাম এই কারনেই আমাকে পালিয়ে আসতে হয় ।
এরপরের কাহিনি সামান্য , তিতিরের বিয়ে হয়ে যায় সমাজের তৃতীয় শ্রেনির একটা পশুর সাথে যে কিনা এক কন্যা সন্তান গর্বে রেখে নিজের স্ত্রিকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেন এমন হবে না ? যে মেয়ের নিজের পিতার পরিচয় নেই,যে কিনা দেখতে কালো তাকে কেন ভদ্র কেউ বিয়ে করবে , আর কেনই বা তার স্বামী তাকে ছেড়ে যাবে না । সে যে মহাপাপী ; যে কিনা একটা সমাজের অশিক্ষা আর নিষ্ঠুর কিছু নিতির ভারে ক্লান্ত ।
আর আমার তিতির, আমার তিতির সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নিজেই মুক্তি লাভ করে । আমার কাছ থেকে ,নিজের স্বামীর কাছ থেকে , সমাজের আরও অনেক মানুষ রূপি পশুর কাছ থেকে,এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে ।
আমি তো ভালোই আছি । নিজে বিয়ে করিনি , এখনো তিতির স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি । হয়তো ও আমাকে কখনো ক্ষমা করে দিবে এই আশায়। হয়তো উপর থেকে সব কিছু দেখে মুগ্ধ করা মুচকি হাসি দিবে এই আশায় । এই হল আমার অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প ।
না, আমার সাথে তিতিরের মিলন হয়নি বলে নয় বরং তিতিরের জন্য আমার ভালবাসা শেষ হবেনা বলেই এটি অসমাপ্ত । যার কোন সমাপ্তি কখনোই হবে না । অনেকক্ষণ কথা বলে তানবির সাহেব থামলেন, তার চোখ ছলছল করতেছে কিন্তু মুখের কোণে মিষ্টি একটা হাসির রেখা ।
তানবির সাহেব কে আমি চিনতাম অবনির বাবা পরিচয়ে । আমাদের সামনের বাসায় থাকেন ,সরকারি চাকুরে , ভাবগম্ভির একজন মানুষ । আজকে এসে আমাকে বললেন তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে , তারপর নিজের গল্পবলা শুরু করলেন ।
এখন আমি জানি উনি অবনির বাবা না ,উনি চিরকুমার মানুষ, অবনি উনার পালক মেয়ে , আর হ্যাঁ অবনি তিতিরের সন্তান যাকে পৃথিবীতে আনতে গিয়ে তিতির পৃথিবী থেকে মুক্তি নিয়েছে ।
কথা শেষ হওয়ার একটু পর অবনি এসে তানবির সাহেবের পিছনে দাঁড়ালো,অবনি কৃষ্ণকায় একহারা গঠনের একটা মেয়ে হয়তো দেখতে মায়ের মতই । আবনির সাথে আমার একটু পরিচয় ছিল বা তারচেয়ে একটু বেশিই বলা যায় । তানবির সাহেব কে বললো বাবা তোমার ওষুধের সময় হল,তানবির সাহেব হাসলেন ।
আর আমি একবার অবনির দিকে তাকালাম । মুহুর্তের জন্য চোখাচোখি হল ,সেই মায়াভরা দুটি চোখ আমার বুকের ভিতর কোথায় জানি চিনচিনে একটা ব্যাথা করে উঠলো ।আবার চোখ তুলে তাকানোর সাহস করলাম না । হয়তো মনে মনে বললাম ; না, আমি ও সাহসি না ।আমি কোন কৃষ্ণবরণ ভালোবাসার জন্ম দিতে পারবো না । ইচ্ছা করলেও ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস আমার কখনোই হবে না ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রুহুল আমীন রাজু লেখায় ধার আছে .....শুভ কামনা রইলো সামনের পথ চলায় .....
সবুজ আহমেদ কক্স ভোট দিলাম ......................নাইস লিখা
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
পবিত্র বিশ্বাস ভালো লাগল। শুভকামনা ও ভোট রইল। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইল।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
সৃজন শারফিনুল অনেক ভাল লাগলো... শুভ কামনা আর ভোট রেখে গেলেম।।
রবিউল ই রুবেন অসম্ভব ভালো। শুভকামনার সাথে ভোট রইল। সময় পেলে আমার লেখা পড়বেন।
Sparna Rahman হাহাহাহা শয়তান
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

২৬ জানুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪